দেশে এখন ভয়াবহ বন্যা চলছে। ৬৪টি জেলার মধ্যে ৩৩টি জেলার লাখ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কোথাও ডুবে গেছে ঘরবাড়ি, কোথাও ভাসমান অবস্থায় বসবাস করছেন বানভাসি মানুষ। নদীভাঙনেও বিলীন হয়ে গেছে অনেকের ঘরবাড়ি। জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা ওই সব মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। পরিবার পরিজন নিয়ে অনেকেই এখন দিশেহারা। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের পাশে নেই অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপি কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। হাতেগোনা দু’চারজন জনপ্রতিনিধি ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ালেও সাহায্য সহযোগিতার পরিমাণ একেবারেই কম; যা দিয়ে ঠিকমতো দু’বেলা দু’মুঠো আহার জুটছে না। দিনকে দিন পেরিয়ে তাদের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কিভাবে সামনে জীবন চলবে, আর কী দিয়ে নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ করবে বা এই বন্যার কবল থেকে কবে তারা মুক্তি পাবেÑ এসব দুশ্চিন্তায় বানভাসি মানুষের মধ্যে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশের ৩৩টি জেলা এখন বন্যাকবলিত। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ। বন্যাকবলিত উপজেলার সংখ্যা ১৬৫টি এবং ইউনিয়নের সংখ্যা এক হাজার ৮৬টি। পানিবন্দী পরিবারের সংখ্যা ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৩১৩টি এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৪ লাখ ৫১ হাজার ৫৮৬ জন। বন্যায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪১ জন।
বন্যাকবলিত এলাকায় ফসলাদি, আসবাবপত্র, গবাদিপশু, ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজসহ নানা জিনিসের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কারো কারো ঋণের টাকায় গড়ে তোলা মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে ওই সব মানুষ লাখ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এর আগে ঘূর্ণিঝড় আমফানের ভয়াবহ আঘাতে খুলনা বিভাগের বেশ কয়েকটি জেলার ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষ করে সাতক্ষীরা জেলার কয়েকটি এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। অনেক এলাকা এখনো পানির নিচে ডুবে আছে। আমফানের ধকল কাটিয়ে না উঠতেই তারা বন্যার পানিতে ভেসে গেছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তারা দীর্ঘদিন বন্যায় পানিবন্দী হয়ে থাকলেও জনপ্রতিনিধিদের কোনো দেখা নেই। তারা কী খাচ্ছেন, কোথায় ঘুমাচ্ছেন, কী করবেনÑ এসব নিয়েও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। বানভাসি মানুষের জন্য সরকারিভাবে ত্রাণের ব্যবস্থা করা হলেও অধিকাংশ এলাকায় সেই ত্রাণ না পাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি নওগাঁর বাসিন্দা আবদুর রাকিবসহ তরুণ যুবকরা সেখানকার বানভাসি মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন। আবদুর রাকিব বলেন, গত জুলাই থেকে এলাকায় বন্যা চলছে। বন্যাকবলিত মানুষ অনেক কষ্টে দিনযাপন করছেন। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ পর্যন্ত তাদের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে দেখিনি। তবে সরকারিভাবে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে বলে জানতে পেরেছি। এটাও তো পর্যাপ্ত নয়।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, বিভিন্ন কারণে সর্বত্র হতাশা কাজ করছে। বন্যা, করোনা বা চলমান রাজনীতি যেটাই হোক না কেন, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী সভার মধ্যে একটি হতাশা কাজ করছে। আমি মনে করি, এই হতাশা থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উৎসাহ উদ্দীপনা তারা হারিয়ে ফেলছে। তিনি বলেন, যারা ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিবিদ দেশের এই পরিস্থিতিতে তারা মনে করছে তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিবিদরা এখন পুরো রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে না। অরাজনৈতিক ব্যক্তিরাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, তারাই পার্লামেন্টে যাচ্ছে; যাদের সাথে মাঠের মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই, অতীতেও জনগণের সাথে এসব মানুষের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি নয়া দিগন্তকে বলেন, জনপ্রতিনিধি বলতে বোঝায় যারা নির্বাচিত হয় জনগণের ভোটে। কিন্তু এখন যারা আছে তারাতো কেউ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নয়। তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি। ফলে জনগণের প্রতি তাদের কোনো প্রতিশ্রুতি, প্রেম-ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা কোনোটাই নেই। আগে যারা জনপ্রতিনিধি ছিল তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, ফলে তারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত, বানভাসি মানুষের কাছে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন, তারা মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে জনগণের কাছে জনপ্রতিনিধি বলতে যে কিছু আছে গত দুইটা নির্বাচনে সেটা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। ফলে জনগণের সাথে যে নেতৃত্বের জায়গাটা, সম্পর্কের জায়গাটা, আস্থার যে জায়গাটা থাকে এটা এখন নেই। এখন কিছু মানুষ সাহায্য করছে কেবলই মানবিক কারণে। সাহায্য করার জন্য রাজনৈতিক যে কারণ থাকে জনগণের সাথে রাজনীতিবিদদের সেই রাজনৈতিক বন্ধন নেই, ভোটের সংস্কৃতি নেই, যে কমিটমেন্ট থাকা দরকার সেগুলো এখন আর আমাদের সমাজে নেই। না থাকার কারণে এই বানভাসি মানুষের কাছে জনপ্রতিনিধিরা যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না।
Leave a Reply